মূল্যস্ফীতি বলতে আমরা যেটা সাধারণ মানুষ হিসেবে বুঝি তা হলো, সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়া। মানে আমি যে টাকায় আগে ১ কেজি মাছ বা শাক-সবজি কিনতে পারতাম, এখন আর সেই একই টাকায় ১ কেজি মাছ বা শাক-সবজি কেনা যাচ্ছে না। আরও বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সহজ ভাষায় এটাই মূল্যস্ফীতি। আর যে পরিমাণ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে, সেটাকে যদি ঐকিক নিয়মে অংক করি তাহলে যে হার পাওয়া যায়, সেটাই হলো মূল্যস্ফীতির হার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গত মে মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৯.৯৪ শতাংশ। যেটা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ! এখন এই মূল্যস্ফীতি যদি বাড়তে থাকে প্রথমেই যেটা হয় সেটা হলো, যারা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ, তারা তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যায়ের একটা অসামঞ্জস্যতার দেখা পায়। যেটা আমরা ইতিমধ্যে আমাদের ব্যক্তি জীবনে লক্ষ্য করতে পারছি। আমাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় কোনো ভাবেই মিলানো যাচ্ছেনা। কারণ ব্যায় যে হারে বেড়েছে, আয় সে হারে মোটেও বৃদ্ধি পায়নি। মজুরি বৃদ্ধির যে হার বিবিএস প্রকাশ করেছে তাতে ৬ শতাংশের মত মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এই অতিরিক্ত খরচ আমাদেরকে মেটাতে হচ্ছে আমাদের জমানো অর্থ থেকে নয়ত ক্রয় কমিয়ে দিয়ে।
যদিও নির্দিষ্ট হারে মূল্যস্ফীতি একটি অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য জরুরি, কিন্তু বর্তমানে আমরা এর যে লাগামহীন হার দেখতে পাচ্ছি, তা মোটেও আমাদের অর্থনীতিতে উন্নয়ন করবে বলে মনে হয় না। বরং মানুষ সঞ্চয়ের প্রবণতা থেকে বের হয়ে তার জরুরি খরচ মেটানোর জন্য টাকা খরচ করতে থাকবে। দিনশেষে দেখা যাবে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে আসবে। কারণ অর্থনীতির খুব বেসিক ধারণা থেকে আমরা জানি যে, বিনিয়োগ আসে সেভিংস থেকে। যেহেতু সঞ্চয় কমে আসবে, সেহেতু বিনিয়োগও কমে আসবে নিজ থেকেই।
অন্যদিকে সরকারের সুদ হারের যে নয়-ছয় নীতি বিদ্যমান, সেখানে যেহেতু ৬ শতাংশের বেশি সঞ্চয়ে সুদ হার নেই, প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বাজারে সঞ্চয়ে কেউেই আগ্রহী হবে বলে মনে হয় না। যদিও গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নতুন মুদ্রানীতি অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ভোক্তা ঋণ দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। যা এতদিন এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ হার ছিল ৯ শতাংশ। বিদ্যমাণ পরিস্থিতিতে নয়-ছয় এর যে বিধান জারি আছে তা এখন তুলে দেওয়াটা সময়ের দাবি।
তাছাড়া সম্প্রতি যে পেঁয়াজের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে, তা কিন্তু মোটেও পেঁয়াজের স্বল্পতার কারণে হয়নি। পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে। সরকার বারবারই এদেরকে প্রতিহত করতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে যা উপলব্ধি হয় তা হলো, দায়িত্বশীলদের দূরদর্শিতা ও দক্ষতার অভাব। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে বারবার ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই দুষ্টু চক্রকে না ভাঙতে পারলে মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে দুষ্টু চক্রের প্রিমিয়াম সবসময়ই যোগ হতে থাকবে, যা মোটেও কম নয়!
আসছে ১৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করতে যাচ্ছে তার নতুন মুদ্রানীতি। যেখানে আমরা আশা করব আমাদের বর্তমান যে ডলার সংকট, উচ্চ লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসতে থাকা সহ অন্যান্য সংকট সমূহের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার হাতে থাকা নিয়ন্ত্রণের টুলগুলো দিয়ে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতির দিকে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: মো. শাহাদাত হোসেন
ব্যাংক কর্মকর্তা
[email protected]
Leave a Reply