পর্ব-১
জন্ম ও বংশ পরিচয়: বীর মুজাহিদ শহীদ তিতুমীরের প্রকৃত নাম মীর নিসার আলী। তিতুমীর নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বংশধারার উত্তরাধিকার বহন করেন তিনি। ১৭৮২ ঈসাব্দ মোতাবেক বাংলা ১১৮৮ সনের ১৪ মাঘ সুবহে সাদিকের সময় বর্তমান ভারতের চব্বিশ পরগানা জেলার বশিরহাট মহকুমাধীন বাকুড়িয়া থানার অন্তর্গত অস্তঃপাতি চাঁদপুর গ্রামে মহাবীর সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন।
ঈসায়ী ১৩২৪ সালের দিকে তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে সৈয়দ শাহাদাত আলী, সৈয়দ আব্বাস আলী মাক্কী ও তাঁদের সহোদরা আবেদা রওশন বিবি এদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। হযরত শাহাদত আলীর একমাত্র পুত্র দরবেশ ও আলেম হযরত সৈয়দ শাহ হাশমত আলী রাজীর অন্যতম পুত্র ছিলেন দরবেশ ও বিশিষ্ট আলেম সৈয়দ আবদুল্লাহ। সৈয়দ আবদুল্লাহর আল্লাহভীরুতা ও জ্ঞান বিচক্ষণতারয় মুগ্ধ হয়ে দিল্লী তখতনশীন বাদশাহ তাঁকে ‘মীর ইনসাফ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে সৈয়দ শাহাদত আলীর বংশধরেরা শাহী আমলে বাদশাহ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ খেতাব ‘মীর’ এবং বংশজাত উপাধি ‘সৈয়দ’ উভয়টাই ব্যবহার করতেন। এই বংশের অধঃস্তন পুরুষ হিসেবে হযরত সৈয়দ শাহ নিসাব আলী মীর ওরফে তিতুমীর মীর হাসান আলীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। সৈয়দ নিসার আলীর পিতা সৈয়দ হাসান আলী মীর পিতৃব্য সৈয়দ উমর দারাজের নিকট মুরীদ হয়ে খেলাফতী সনদ শিজরা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সৈয়দ উমর দারাজ পৌত্র সৈয়দ নিসার আলীর জন্ম সংবাদ শুনে তার জন্য বিশেষ দোয়া করেন এবং চাঁদপুর গ্রামে এসে শিশু নিসার আলীর আবীকা করে নাম রেখেছিলেন নিসার আলী। এই বংশধারায় প্রথম পুত্র হিসাবে নিসার আলরি আকীকা বেশ জাঁকজমক সহকারে সম্পন্ন হয়েছিল।
সৈয়দ নিসার আলী মীর –এর তিতুমী নামকরণের একটি মজার ঘটনা আছে। তাঁর বয়স যখন সাড়ে পাঁচ বছর তখন একবার জ্বরে আক্রান্ত হলে সাধারণ পাচন খাওয়ানো হয়। কিন্তু তাতে তাঁর জ্বর আরোগ্য না হলে ঘুষড়া ঔষধ প্রস্তুত করে খাওয়ানো হলে আরোগ্য লাভ হয়। বিভিন্ন তিক্ত গাছ গাছড়ার তৈরি ঘুষড়া ঔষধ খুব তিতা হত। কোন রোগীকে সহজে খাওয়ানো যেত না। কিন্তু শিশু সৈয়দ নিসার আলী তিতা ঘুষড়া ঔষধ সেবনে তেমন কোন আপত্তি করতো না। স্বাভাবিকভাবেই এসব ঔষধ কেতেন বলে তাঁর দাদী সৈয়দ শাহ কদম রসূল-এর স্ত্রী জয়নব খাতুন দৌহিত্র নিসার আলীকে আদর করে ‘তিতা মিয়া’ বলে ডাকতেন। দাদীর আদুরে ডাক ‘তিতা মিয়া’ পরিবার ও প্রতিবেশীর মধ্যে ‘তিতামীর’ তিসাবে পরিচিতি লাভ করে এবং পরবর্তীকালে ‘তিতামীর’ থেকে ‘তিতুমীর’ হিসাবে সৈয়দ নিসার আলী পরিচিতি লাভ করেন।
শিক্ষা:
সৈয়দ নিসার আলীর বয়স যখন ৪ বছর ৪ মাস ৪ দিন, তখন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী পুত্রের হাতে তখতী ধরিয়ে বিদ্যা শিক্ষার শুভ সূচনা করেছিলেন। বিদ্যা শিক্ষার শুভ সূচনা করেই নীরব ছিলেন না পিতা। পুত্র সৈয়দ নিসার আলী যাতে যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে বিদ্যার্জন করতে পারে সেজন্যেই উপযুক্ত শিক্ষকদের সন্ধান করতে লাগলেন। সে সময় চাঁদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম হয়দারপুরে শিক্ষা সুব্যবস্থা ছিল না। কয়েক গ্রামের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উস্তাদ হয়দারপুর নিবাসী মুনশী লাল মিয়াকে সৈয়দ নিসার আলীর আরবি, ফারসী ও উর্দু শিক্ষার শিক্ষক নিযুক্ত করলেন। আরবি ফারসী ও উর্দু শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাভাষা এবং অংক শিক্ষার জন্য সেরপুর গ্রামের বিজ্ঞ পণ্ডিত রামকমল ভট্টাচার্যকে নিয়োগ করেন। উস্তাদ ও পণ্ডিত উভয়েই বালক নিসার আলীর মধ্যে একটা অসাধারণ মেধার পরিচয় পান। মেধাবী ছাত্র নিসার আলীকে পেয়ে উস্তাদ ও পণ্ডিত উভয়ই আন্তরিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা দান করেন। উস্তাদ লাল মিয়া ও পণ্ডিত রামকমল ভট্টাচার্যের সুযোগ্য ছাত্র নিসার আলীকে উচ্চ শিক্ষা দেয়ার জন্য পিতা সৈয়দ হাসান আলী যখন চিন্তা-ভাবনা করছেন ঠিক সে সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বিহার শরীফের একজন বিশিষ্ট আলেম হাফিজ নেয়ামত উল্লাহ চাঁদপুর বেড়াতে আসেন। হাফিজ নেয়ামত উল্লাহর আগমনবার্তা শুনে সৈয়দ হাসান আলী তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং পুত্র নিসার আলীর উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ করেন।
শিক্ষাঅনুরাগী সৈয়দ হাসান আলী হাফিজ নেয়ামত উল্লাহর সাথে আলোচনাকালে উচ্চ শিক্ষা প্রদানের জন্য একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছিলেন। এ বিষয়ে তিনি চাঁদপুর ও পার্শ্ববর্তী হায়দারপুর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। চাঁদপুর ও পার্শ্ববর্তী হায়দারপুর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। চাঁদপুর ও হায়দারপুর গ্রামের জনগণ শাহ সাহেবকে বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। শাহ সাহেবের প্রস্তাব মত দুই গ্রামের মাঝখানে প্রতিষ্ঠিত হলো মাদ্রাসা। নবপ্রতিষ্ঠিত মাদরাসার প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হলেন হাফিজ নেয়ামত উল্লাহ। দ্বিতীয় শিক্ষক মুনশী লাল মিয়া এবং তৃতীয় শিক্ষক পণ্ডিত রামকমল ভট্টচার্য। তরুণ প্রধান শিক্ষক উৎসাহিত হয়ে পূর্ণোদ্যমে ছাত্র গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একাধারে দুই বছর যাবত ছাত্রদের শরীয়তী ও তরীকতী শিক্ষাদন করেন। দুই বছর একটানা শিক্ষাকতা করার পর হাফিজ সাহেব স্বদেশ বিহার শরীফ যাবার অনুমতি চাইলেন। সৈয়দ নিসার আলী পিতামাতার অনুমতি নিয়ে উস্তাদ হাফিজ নেয়ামত উল্লাহর সাথে বিহার শরীফ ভ্রমণে যান। বিহার শরীফ ও অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থান, পীর আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করে ছয় মাস পর পুনরায় চাঁদপুরে ফিরে আসেন।
সৈয়দ নিসার আলী আঠার বঠর বয়সে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ হেফয করেন। তাঁর ভরাট কণ্ঠের পবিত্র কুরআন তেলওয়াত সকলকে মুগ্ধ করতো। আরবি ও ফরাসী ভাষায় তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল। তিনি ফরাসী ভাষা ও ব্যাকরণশাস্ত্র, তাসাওউফ শাস্ত্র, ফরাসী কাব্যশাস্ত্র, আরবি মান্তেক, ফরায়েজ, দর্শন ও কাব্য শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করেন েএবং এই বিষয়ে বিশেষ জ্ঞাণপ্রাপ্ত হন। তিনি আরবি, ফারসী, উর্দু ও বাংলাভাষায় অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন। যখন যে ভাষাতে তিনি বক্তৃতা করতেন তখন তাঁকে সে ভাষাউ একজন মনে হতো। তাঁর হৃদয়গ্রাহী ভাষণ মানুষকে মোহিত করতো। সৈয়দ নিসার আলী প্রিয় উস্তাদ ও পণ্ডিত মহাশয়ের কাছ থেকে যা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা শুধু কণ্টস্থ করে বসে থাকতেন না। নিজের জীবনে পূর্ণরুপে তার বাস্তবায়ন ঘটাতে চেষ্টা করতেন। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে তাঁর জ্ঞানকে তিনি সীমাবদ্ধ রাখেননি-প্রাকেৃতিক জ্ঞনের সাথে তাঁর পুঁথিগত জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলে নিজের জীবনে। পিতামহ সৈয়দ শাহ কদম রসূল ও পিতা সৈয়দ হাসান আলী মীরের মত তিতুমীরের দৈহিক গঠন ছিল সুঠাম। সমবয়সী অন্যান্য কিশোরের তুলনায় তিনি ছিলেন নজরকায়া সুন্দর। দৈহিক গঠনের সাতে তাল মিলিয়ে তাঁর শক্তিও ছিল প্রচুর। খেলাধুল ও শরীর চর্চার মাধ্যমে তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।
বাঙ্গালী কিশোর যুবকেরা এ সময় খেলাধুলার সাথে শরীর চর্চা, ডন বৈঠকে বিশেষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মাদরাসার শিক্ষক হাফিজ নেয়মত উল্লাহ ছিলেন কুস্তি ও মল্লযুদ্ধে পারদর্শী। তাঁরই উৎসাহে মাদরাসা প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছিল ব্যায়ামাগার বা শরীর চর্চার আখড়া। এ আখড়ার উস্তাদ ছিলেন হায়দারপুর নিবাসী শেখ মুহাম্মদ হানিফ। হাফিজ নেয়ামত উল্লাহ মাদরাসায় যেমন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন ঠিক তেমনি আখড়াতেও তাঁর নিয়ম-শৃঙ্খলা ছিল কঠোর। শরীর চর্চা শিক্ষার সাথে সাথে সামরিক শিক্ষা প্রদান করা হতো। লাঠি খেলো, ফাল-সসড়কি খেলা, তরবারি ভাজা, তীর গুলতি চালনা, গেটে কামান, বাঁশের বন্দুক চালনায় ছাত্ররা বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। হাফিজ নেয়ামত উল্লাহ শরীর চর্চা , অস্ত্র চালনা কৌশল শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় রাজনীতিও শিক্ষা দিতে লাগলেন। এই আখড়ায় দুইজন শ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন। একজন আখড়ার প্রাথমিক শিক্ষক শেখ মুহাম্মদ হানিফ ও অন্যজন সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর।
হাফিজ নেয়ামত আলীর সহচার্যে থেকে তিতুমীর যেমন কুস্তি ও মল্লযুদ্ধে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক তেমনি তিনি ধর্মীয় বক্তৃতা এবং রাজনৈতিক বক্তিৃতায় বিশেষ খ্যাতি লাভ করলেন। বাকচাতুর্যে তিনি এতই পারদর্শী ছিলেন যে, উস্তাদ নেয়ামত উল্লাহ তাঁর কথাবার্তা মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করতেন। মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয় আকর্ষণ করার এক সম্মোহনী শক্তি আল্লাহ পাক তাঁর কণ্ঠে দিয়েছিলেন।
বিবাহ:
বাদুড়িয়া থানার খাসপুর গ্রামটি তখন বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিল সিদ্দিকী পরিবারের জন্য। ধানসম্পদ-ঐশ্বর্য-খ্যাতি সব কিছুতেই ছিল ভরপুর। বংশীয় ঐতিহ্যে বিবাহ শাদী সম্পন্ন হত। এ বংশে কন্যাদের বিবাহের দেনমোহর ধার্যের রীতি ছিল নির্ধারিত। সতের শত টাকা এবং পাঁচ আশরফী। সিদ্দিকী পরিবারের কন্যাদের দেনমোহর বাধার সে নিয়মটি এখনও প্রচলিত আছে। বিখ্যাত এ পরিবারে পুত্রের যোগ্য একজন পাত্রীর সন্ধান পেয়ে পিতা সৈয়দ হাসান আলী প্রস্তাব পাঠোলেন সেখানে। ইতোমধ্যে সৈয়দ হাসান আলীর সুনাম খ্যাতিও চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সিদ্দিকী পরিবারেও সে সুনামের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। খাসপুর গ্রামের বিখ্যাত দরবেশ হযরত শাহ সুফী মুহাম্মদ আসমত উল্লাহ সিদ্দিকীর পৌত্রী এবং হযরত শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকিীর সুযোগৗ কন্যা মায়মুনা খাতুন সিদ্দিকার সাথে তিতুমীরের শাদী মুবারক সম্পন্ন হয়ে যায়।
হজ পালন ও মুর্শিদের সাক্ষাৎ: সৈয়দ নিসার আলীর বয়স তখন উনচল্লিশ বছর। তিনি বাড়িতে এসে তাঁর মাতা, মাতামহ, সহধর্মিনী, ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হজে যাবার কথা ব্যক্ত করলেন। হজে যাবার যে ইঙ্গিত তিনি হযরত জাকী শাহ থেকে পেয়েছিলেন তা ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগে অশ্রুধারা নেমে এলো। তাঁর জননীর হৃদয়েও যেন একই সুর বেজে উঠেছিল। তিনি পুত্রকে কাছে টেনে মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললেন-হজে যাওয়া তো এক সৌভাগ্যের কথা। পবিত্র মক্কা-মাদীনা তো তোমাদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান। পবিত্র রওজা জিয়ারত করার সৌভাগ্য সকলের হয় না বাবা। আল্লাহ পাক তোমার মনের আশা পূর্ণ করুন।
মা ও অন্য সকলের অনুমতি লাভ করে তিতুমীর পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তখনকার দিনে এ দেশ থেকে লোক হজে গেলে বেশ সময়ের প্রয়োজন হতো। আর সইতে হতো দীর্ঘদিনের পথ চলার কষ্ট। তাই মওসুম শুরু হওয়ার তিন চার মাস আগ্টে িযাত্রা করতে হতো। আল্লাহর অসীম রহমতে যথাসময়ে তিনি পবিত্র মক্কায় পৌঁছে হজ পালন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রওজা জিয়ারতের উদ্দেশে মদীনায় যান।
মদীনা শরীফে যাবার প্রাক্কালে হযরত শাহ মওলানা মুহাম্মদ হুসাইনের সাথে তিতুমীরের পরিচয় ঘটে। হজ পালন করতে এস তিতুমীর তাঁর মুর্শিদের দর্শনের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। যার সাথেই আলাপ হতো তাঁকেই তাঁর পীর বা মুর্শিদ সম্পর্কে জিজ্ঞিস করতেন। েএ পর্যায়ে তিতুমীর মুহাম্মাদ হুসাইনকে তাঁর মুর্শিদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- আমার মুর্শিদ সম্কর্কে জিজ্ঞিস করলে তিনি বললেন, আমার মুর্শিদ কেবলা ভারতবর্ষেরিই লোক। তাঁর জন্মস্থান বেরলভী শহরে। আমার মুর্শিদের নাম সৈয়দ আহমদ রাজী। আর আক্ষেপ করে বললেন, ভাই! মুর্শিদের দর্শন লাভ করার কোনো সেভৈাগ্য আমার হয়নি। জানি না আল্লাহ পাক আমাকে কবে নাগাদ তাঁর দর্শন মেলাবেন।
উপমাহাদেশের প্রখ্যাত সাধক, ইসলামী চেতনার অগ্নিপুরুষ হযরত শাহ সৈয়দ আহমদ রাজী তখন তাঁর মুরীদদের ভেতর থেকে সাডে সাতশত নারী-পুরুষের এক বিরাট কাফেলাসহ পবিত্র হজ পালন করতে গিয়েছিলেন। মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন তিতুমীরকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থি হলে মুর্শিদ প্রথম দেখাতেই তিতুমীরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ দিন যাবত মুর্শিদ তাঁর হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে তিতুমীকে যেভাবে আকর্ষণ করে আসছিলেন, আজ তাকে কাছে পেয়ে মুর্শিদও বিহ্বাল হয়ে পড়লেন। আলাপ-আলোচনা ও যাচাই বাছাই পর্বে দুই দিন কেটে গেল। তিতুমীর ভাবলেন, িএমন মুর্শিদের দেখা পবার জন্য হয়তো আল্লাহ পাক এতদিন আর কারও মুরীদ করেননি। হযরত শাহ সৈয়দ আহমদ রাজী তিতুমীরের সাথে প্রাণখুলে কথা বলে বুঝতে পারলেন তাঁর মুরীদদের মধ্যে তিতুমী হবেন িএকজন শেষ্ঠ মুজাহিদ। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, তৃতীয় দিনেই সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর চার তরিকা মতে শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নিকট মুরীদ হলেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই হযরত শাহ সৈয়দ আহমদ তাঁর মুরীদদের বিশাল বাহিনীসহ রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রওজাসহ অন্যান্য বুযুর্গের রওজা জিয়ারতের উদ্দেশে মদীনা শরীফে রওনা হন। মদীনা শরীফে পৌঁছাবার অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের সাধনা সমাপ্ত হয়েছিল। মদীনায় পাক রওজার মধ্যেই সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর তাঁর মুর্শিদের কাছ থেকে খেলাফতী সনদ ও শিজরা লাভ করেন। তিতুমীর তাঁর মুর্শিদের চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন। কাফেলা কয়েকদিন পবিত্র মদীনায় অবস্থান করার পর ইরান, ইরাক, দামেশক, মিসর, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থান দর্শন ও পীর আউলিয়া বুযুর্গানের মাজর জিয়ারত শেষে হযরত শাহ সাইয়েদ আহমদ রাহী বাসস্থান এলাজাবাদের রায়বেরেলী বা সেলভীতে পৌঁছলেন। সেখানে হাজীদের বিরাট তকাফেলা পৌছবার পর তিনি সকলকে তিন দিন বিশ্রামের উপদেশ দেন। তিন দিন বিশ্রাম শেষে হযরত মওলানা সাইয়েদ আহমদ রাজী মুরীদদের সঙ্গে এক পরামর্শ সভায় মিলিত হন। তিনি ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলের মুরীদদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশ জারি করেন। তিনি বাঙ্গালী খলিফাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আমরা অন্যান্য প্রদেশ ভ্রমণ করে যখন পাটনায় অবস্থান করবো তখন মাওলানা আবদুল বারী খাঁ (মওলানা আকরম খাঁর পিতা), মওলানা মুহাম্মদ হুসাইন, মওলানা শরীয়ত উল্লাহ, মওলানা সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর, মাওলানা সুফী কোদাদাদ সিদ্দিকী (ড. আবদুল গফুর সিদ্দিকীর পিতৃব্য) ও মাওলানা কারামত আলীকে সংবাদ প্রেরণ করা হবে, যাতে করে তারা কলকাতা আগমন ও চূড়ান্ত বৈঠকের পবিভিন্ন প্রস্ততি গ্রজণ করতে পারেন।
মীর নিসার তিতুমীর মুর্শিদের কাছ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে অন্যান্য পীর ভাইদের সাথে বেরেলভী থেকে কলকাতা অভিমুখে রওনা হলেন এবং পরে স্বগ্রাম চাঁদপুর এসে পৌঁছালেন। হজ শেষে দীর্ঘদিন পর গ্রামে পৌঁছালে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন আলহাজ সৈয়দ নিসার আলী ও আলহাজ নিসার আলীর মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখতে পেলেন। আলহাজ সৈয়দ নিসার আলীর মুখে প্রতিভাত হতে থাকে নূরের জ্যোতি, যা সাধারণ মানুষকেও আকর্ষণ করে কি এক ভক্তি শ্রদ্ধায়।
সংগ্রামী জীবন:
ইংরেজদের দখলে এ দেশ চলে যাবার পর সাধারণ কৃষক শ্রেণীর মুসলমানরা চরম বিপর্যয়ে দিন কাটাতে থাকে। এসব মুসলমানের দিলে ভরা কুসংস্কার। পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, লক্ষ্মী পূজায় অভ্যস্ত ছিল তারা। পীরকে মনে করতো ত্রাণকর্তা, পীরের কবর মাজার ছিল তাদের অভাব অভিযোগ মেটাবার আশা ভরসার স্থাল। তিতুমীরের মুর্শিদ হযরত সাইয়েদ আহমদ রাজীও মুসলমানদের একই দুর্দশার কথা ব্যক্ত করেছেন। মক্কায় তাঁর সাথে সাক্ষাত হবার পর থেকে আধ্যাত্মিক সবকের সাথে সাথে জিহাদের সবকও দেন। এ জিহাদ পরাধীনতার বিরুদ্ধে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর মুসলমানদের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আর সৈয়দ নিরাস আলী তিতুমীর তাঁর মুর্শিদের প্রতি এজন্য অধিক আকৃষ্ট ছিলেন।
হজে যাবার আগে ঘটনাক্রমে এক জমিদারের সাথে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের বিরোধ বাধে। জমিদার তাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করে। ফলে তাঁর কারাদণ্ড হয়। কারামুক্তির পরই তিনি হজে যান এবং ্যিফরে আসেন ১৮২৭ ঈসাব্দে।
শাহাদত: ১৮ নভেম্বর, ১৮৩১ শুক্রবার দিবাগত রাতটা ছিল মহান বীর তিতুমীরের জীবনের শেষ রাত। এ রাতে তিনি আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। মিসকীন শাহ সে রাতে তাঁর পাশে পাশেই ছিলেন। মিসকীন শাহ তাঁর পাশে বসে বললেন- যে কাজের জন্য আপনার নিকট আমার আগমন সে কাজ শেষ হয়েছে। আমি আপনার শাহাদাত প্রাপ্তি পর্যন্ত এখানে অবস্থান করবো। আপনার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ হযরত শাহ সাইয়েদ আহমদ রাজী আপনারই মতই জিহাদ করতে করতে বিগত ৬ মে শুক্রবার বালাকোট প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছেন। তিনিও আপনার অপেক্ষা করছেন স্বাগত জানাবার জন্য। আসুন, আমরা এখন একটু ইহজগতে শেষবারের মত আলিঙ্গণাবদ্ধ হই। পরজগতে আমি যেন আপনার সহচাররুপে স্থান পাই, আপনি তার জন্য দোয়া করবেন।
মিসকীন শাহের এ কথা শোনার পর তিতুমীরের হৃদয় তোলপাড় হয়। দু’জনে দাঁড়িয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন। অনেকক্ষণ আলিঙ্গনাবদ্ধ থেকে দু’হনে বসে পড়লেন। তিতুমীর মিসকীন শাহকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এ জগতে কিছু দিনের জন্য আমাদের চোখের দেখা হয়তো হবে না। আল্লাহর রহমতে পরকালে আমরা উভয়ে মিলিত হব।
ইংরেজ বাহিনীর বিশাল যুদ্ধসাজ-সজ্জাকে মোটেই ভয় পেল না বাঁশের কেল্লার মুজাহিদ বাহিনী। পূর্বে মারা যাওয়া কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যের লাশ বাঁশের কেল্লার চারদিকে রাখা হয়েছিল। এ লাশ ঝুলিয়ে রাখার কারণ ছিল, ইংরেজ সৈন্যদেরকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া। কিন্তু বিশাল ইংরেজ বাহিনী এবং আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত থাকায় লাশ দেখে দুর্বল হবার কথা নয়। সকাল নয়টায় যুদ্ধের ব্যান্ড বেজে ওঠে। সেনাপতি স্টুয়ার্ট ২টি কামান প্রধান ফটকের সামনে স্থাপন করলেন। কামান দেখে মুজাহিদ বানিনী নারয়ে তাকবির ধ্বনি দিতে থাকে। মহাবীর গোলাম মাসুম মুজাহিদ বাহিনীকে বীরের মত আক্রমণ করার আদেশ দিলেন। বীর মুজাহিদ বাহিনী লাঠি, সড়কি, বাঁশের বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইংরেজ বাহিনীর উপর। যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহত হলো। এভাবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর সেনাপতির আদেশে কামানের সত্যিকার গোলাবারুদ পুরা হলো। কামানে অগ্নিসংযোগের সাথে সাথে কয়েকটা গোলা বাঁশের কেল্লা গুঁগিয়ে দিল। কামানের দুটো গোলা এসে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরকে আঘাত করলে তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেই সাথে নিভে যায় স্বাধীনতাকামী এক বীরপুরুষের জিহাদী সংগ্রাম। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না আলাইহি রাজিউন। এ দিনটি ছিল বাংলা ১২৩৮ সনের ৫ অগ্রহায়ণ শনিবার।
এই অসম যুদ্ধে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরসহ পঞ্চশ জন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন এবং ত্রিশ জন গুরুতর আহত হন। আহতসহ তিনশ’ পঞ্চাশজন বন্দী হয়। গুরুতর আহতদের মধ্যে তিতুমীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ গওহর আলী মীর ছিলেন। তাঁর একটা উরু গোলার আঘাতে উড়ে গিয়েছিল। বন্দীদের মধ্যে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে প্রহসনের বিচার করা হয়। বাকীদের মুক্তি দেয়া হয়। বিচারে মহাবরি শেখ গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেয়া হয়। অভিযুক্ত ৩ জনকে খালাস দেয়া হয়। অবশিষ্ট ১৩৬ জনের মধ্যে ১১ জনকে যাবজ্জীবন, ৯ জনকে ৭ বছর মেয়াদে, ৯ জনকে ৬ বছর মেয়াদে, ১৬ জনকে ৫ বছর মেয়াদে, ৩৫ জনকে ৪ বছর মেয়াদে, ৩৪ জনকে ৩ বছর এবং ২২ জনকে ২ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সূত্র. বাংলাদেশ পীর আওলিয়াগণ
Leave a Reply