হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তিনি অসুস্থতা অনুভব করেন, বেলা বাড়ার সাথে সাথে অসুস্থতা আরও বেড়ে গেলে ওই দিন দুপুরের দিকে আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়াকে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে চট্টগ্রাম নগর সিএসসিআর প্রাইভেট হাসপাতালে এইচডিইউতে ভর্তি করানো হয়। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি হলে গতকাল শুক্রবার ঢাকা ইউনাইটেড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সকল চেষ্টার অবসান ঘটিয়ে রাত ২টায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
উম্মুল মাদারিসখ্যাত জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার অন্তর্গত আলমপুর গ্রামে কাজি সালেহ আহমদের বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কাজি আব্দুল আজিজ বিন চাঁদ মিয়া বিন আসমত আলি জমিদার বিন কাজি মুহাম্মদ সালেহ এবং মাতা আঞ্জুমান খাতুন।
শিক্ষা জীবন
১০ বছর বয়সে হাটহাজারী মাদরাসার ফোরকানিয়া মক্তব বিভাগের শিক্ষক কারী নুরুল হক আলমপুরী রহ.-এর কাছে মাদরাসা নেসাবের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা অব্যাহত রেখে হাটহাজারী মাদরাসা থেকেই ১৯৭৩ সাথে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন।
তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় লেখাপড়ার দীর্ঘ সময়ে মুফতিয়ে আযম ফয়জুল্লাহ রহ., খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ রহ., শায়খুল আদব আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী রহ., আল্লামা আবুল হাসান রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল আজীজ রহ., আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম রহ., মুফতি আহমদুল্লাহ রহ., মাওলানা হামেদ রহ., আল্লামা নাদেরুজ্জাম রহ., মাওলানা ইব্রাহীম আলমপুরী রহ. ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. আল্লামা আতিক জমিরী রহ., মাওলানা খালেদ হাবীবী রহ., মাওলানা সিদ্দিক আহমদ হাবীবী রাহ. হাফেজ মাওলানা ওমর হাবীবী রহ. ও মাওলানা ক্বারী ইয়াহইয়া রহ. প্রমুখের সান্যিধ্য লাভ করেন।
কর্মজীবন
১৯৭৩ সাথে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর হাটহাজারীর উপজেলার গড়দুয়ারা মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি গড়দুয়ারা মাদরাসায় ৯ বছর, মাদার্শা মাদরাসায় তিন বছর, ঈছাপুর ফয়জিয়া তাজবিদুল কুরআন মাদরাসায় ছয় বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ১৯৯১ সালে দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় যোগদান করেন।
শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকে আজ অবধি তার মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দিয়ে উর্দুখানা থেকে দাওরায়ে হাদিস ও তাফসির জামাত পর্যন্ত মানতেক, উলূমে হাদিস, উলূমে ফিক্বহ, উলূমে তাফসীর, উলূমে ফারায়েযসহ পর্যায়ক্রমে প্রায় সকল কিতাবের তিনি অধ্যাপনা করেন। উলূমে তাফসির, উলূমে হাদিস, উলূমে মানতেক, ও উলূমে ফারায়েযের উপর আল্লামা ইয়াহইয়ার দক্ষতা ছিল সর্বজন বিদিত।
হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব
২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার এক শূরা বৈঠকে মুফতিয়ে আযম আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামীকে মাদরাসার মহাপরিচালক পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। শূরা সিদ্ধান্তের এ ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই আব্দুচ্ছালাম চাটগামী রহ. ইন্তিকাল করেন। পরে ওই একই মজলিসে শূরার বৈঠকে আল্লামা ইয়াহইয়াকে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম বা মহাপরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। সেই থেকে ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এর আগে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত মজলিসে শূরার বৈঠকে আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহিয়াকে তিন সদস্যবিশিষ্ট মজলিসে ইদারি (মাদরাসা পরিচালনা কমিটি)-এর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
প্রশাসনিক দক্ষতা
দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পদে নিযুক্তির আগে আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ. দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস ছিলেন। মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি মাদরাসার প্রশাসনিক বিভিন্ন দফতরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। তিনি কয়েক যুগ ধরে দারুল উলূম হাটহাজারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মুখ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.-এর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাদরাসা পরিচালনায় প্রশাসনিক উদ্ভুত কোন সমস্যার মুখে পড়লে আল্লামা ইয়াহইয়া রহ. তা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। এছাড়াও তিনি কয়েক যুগ ধরে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার হিসাব বিভাগ পরিচালনা ও উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।
অন্যান্য দায়িত্ব
আল্লামা ইয়াহইয়া বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রন্তের অসংখ্য কওমি মাদরাসার শূরা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
তিনি ঈমান-আক্বিদাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির, কওমি মাদরাসার কেন্দ্রীয় বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর সহসভাপতি, খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের সভাপতি, হাইয়াতুল উলইয়া বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
Leave a Reply